এসপির সঙ্গে দেখা করতে লাগে না অনুমতি
ফরিদপুর: পুলিশ সুপার (এসপি) আলিমুজ্জামান যার অফিসের দরজা-জানালা খোলা থাকে সবসময়। কোনো অনুমতি ছাড়াই সকাল থেকে রাত অবধি যে কেউই অনায়সে ঢুকতে পারেন তার অফিসে। ফরিদপুরের এই এসপিকে অসহায়-গরীবদুঃখী থেকে শুরু করে সব ধরনের বিচারপ্রার্থীরা বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল মনে করেন। নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলায় গন্ডব গ্রামে জন্ম নেয়া এ পুলিশ সুপার চলাফেরাও করেন খুব সাদামাটা ভাবে। কোনো ধরনের নিজস্ব বডিগার্ড ছাড়াই রাস্তা-ঘাটে মর্নিং ওয়াক করার দৃশ্য যে কারোরই চোখে পড়ে। স্কুল শিক্ষক বাবার নীতি ও আদর্শকে বুকে ধারণ করে পথচলা যার স্বপ্ন। বাবা মো. ওলিয়ার রহমান ছিলেন এমপিওভুক্ত একটি স্কুলের শিক্ষক। যিনি ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা পয়সায় নিজ বাড়িতে প্রাইভেট পড়াতেন। পথের অসহায়দের ডেকে এনে নিজ বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। কোনো স্বার্থ ছাড়াই দাঁড়াতেন বিপদগ্রস্তদের পাশে, উপকার করতেন সবার। বাবার এই নীতিকে লালন করেন এসপি আলিমুজ্জামান। নিজেও স্বপ্ন দেখেন বাবার আদর্শকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। নির্লোভ ও নিরহংকার এই মানুষটি স্বপ্ন বুনেন মানুষের জন্য কিছু করে যেতে। তাই তো দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কিনে দেন বই কিংবা স্কুল ড্রেস, অসহায়দের তৈরি করে দেন বাড়ি, রোগীদের করে দেন চিকিৎসার ব্যাবস্থা। শীতের রাতে ঘুরে ঘুরে পথচারীদের গায়ে জড়িয়ে দেন শীতবস্ত্র। রমজানে সেই সব পথচারীদেরই করার সেহরী ও ইফতার। করোনা ভয়াবহ রুপ ধারণ করলে মানুষ যখন দিশেহারা, ঠিক তখন জীবনের মায় ভুলে পাশে দাড়িয়েছেন মানুষের। অসহায় মানুষ যখন পেটের ক্ষুধায় কাতর, তখন সব জায়গায় ব্যর্থ হলেও জায়গা মিলেছে এই পুলিশ সুপারের দরজায়। তিনি তাদের চাল-ডাল কিংবা খাদ্যসামগ্রী বিনে দিয়ে দিয়েছেন সান্তনা। করোনায় মরদেহ যখন দাফন কিংবা সৎকার করতে ফেলে রাখা হয়েছে তিনি তখন মরদেহটির দাফন ও সৎকারের ব্যবস্থা করেছেন। করোনা আক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি পৌছে দিয়েছেন খাবার, সরবরাহ করেছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার কিংবা এম্বুলেন্স সেবা। এভাবেই জীবন বাজী রেখে মানুষের সেবা করতে গিয়ে নিজেই আক্রান্ত হন করোনায়। তবুও পিছপা হননি মানুষের সেবা করা থেকে। সেবা নিতে আসা লাবন্য বেগম নামে এক গৃহবধূ বলেন, শুনেছি এসপি স্যার নাকি অনেক ভালো মানুষ। তাই তো কোথাও বিচার না পেয়ে সরাসরি এসপি স্যারের কাছে এসেছি। এসে দেখি তিনি তার কক্ষের দরজা খোলা রেখে অফিস করছেন। পরে অফিসে ঢুকে সরাসরি স্যারের সাথে কথা বললাম। স্যার, আমার কথা মনোযোগ সহকারে শুনে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। ফরিদপুরের সালথা থেকে সেবা নিতে আসা শামীম মাতুব্বর নামে এক কৃষক বলেন, স্যার সবসময় রুম খোলা রেখে অফিস করেন। আমি লুঙ্গি পরে একদিন স্যারের সাথে দেখা করেছি। স্যারের অফিসের দরজার সামনে দাড়িয়ে দেখা করার অনুমতি চাইলে, তিনি বলেন আসার অফিসে ঢুকতে কোনো অনুমতির দরকার নেই। চলে আসুন। শামীম নামের এই কৃষক আরও বলেন, এই রকম অফিসার যদি সব অফিসে থাকতো, তাহলে আমাদের মত গরীব মানুষের ন্যায্য অধিকার পেতে কস্ট হতো না। এরকম একাধিক সেবাপ্রত্যাশীদের যাতে কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে না হয় সে কথা মাথায় রেখে সবসময় দরজা খোলা রেখে অফিস করেন। সম্প্রতি পুলিশের জন্য ৬ তলা বিশিষ্ট একটি ভবন তৈরি করা হয়েছে তবে সে ভবনে অনান্য পুলিশ কর্মকর্তারা অফিস করলেও সেবাপ্রত্যাশীদের কষ্ট হবে এমন কথা চিন্তা করে এসপি পুরানো একটি ভবনের নিচ তলার একটি কক্ষে অফিস করেন। সত্যিই এসপি আলিমুজ্জামান স্যার একজন মানবিক পুলিশ অফিসার। আল্লাহপাক যেন তাঁকে দীর্ঘায়ু দান করেন। এসব বিষয় জানতে কথা হয় এসপি জনাব আলিমুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, মানুষ তো মানুষের জন্য। মানুষকে ভালোবাসা ও সেবা করা বড় ইবাদত। মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আমি আনন্দ খুঁজে পাই। দরজা-জানালা খোলা রাখার ব্যাপারে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমি ফরিদপুরে যোগদান করার পরে অফিসের দরজা-জানালার পাশ দিয়ে লোকজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখতাম। পরে কৌতুহল হলে তাদের বিষয়টি জানতে চেস্টা করি। পরে দেখা গেল, মূলত দরজা-জানালা বন্ধ থাকাতে তারা ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। বিষয়টি সমাধানে সিদ্ধান্ত নেই দরজা-জানালা খোলা রেখে অফিস করার। পরে দরজা জানালার পাশে কাউকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই তাকে ডেকে কারণ জিজ্ঞাসা করাসহ তাদের সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে তাৎক্ষণিক সেবা দেবার চেস্টা করতাম। এসপি আলিমুজ্জামান আরও বলেন সব এসপি-ডিসির বডিগার্ড-ড্রাইভার ও পিয়ন নিজেকে এসপি-ডিসি মনে করেন। তাই তাদের সঙ্গে দেখা না করা ও অনুমতি ছাড়াই আমার অফিসে এসে কেউ যেন বিড়ম্বনায় না পড়েন, সে জন্যই দরজা-জানালা খোলা রেখেখে অফিস করি। যাতে কোনো ভয়ভীতি ছাড়াই সরাসরি আমার অফিসে ঢুকতে পারেন সেবাপ্রত্যাশীরা।