এমপি মনোনয়নে পরিবারতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসছে আ.লীগ
দেশের নির্বাচনী রাজনীতির প্রায় সব স্তরে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব স্বাভাবিক চিত্র। সেটা ইউনিয়ন হোক কিংবা সংসদ নির্বাচন। এমনকি সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও এটা দেখা যায় হামেশা। তবে বিভিন্ন স্তরে নির্বাচনের ক্ষেত্রে এটা সাধারণে চোখে পড়ে বেশি। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও নানা সময়ে সমালোচনা ও ক্ষোভ দেখা গেছে।
এই রীতি দেশের প্রায় সব দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাবা এমপি হলে তার শূন্যস্থানে স্ত্রী, পুত্র, কন্যারা এমপি হন। একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও ছিল সেই চিত্র। কিন্তু সেই রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এর প্রতিফলন ঘটেছে বিগত উপনির্বাচনগুলোতে।
সর্বশেষ গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপনকে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে। সদ্য প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়ার এই আসনে দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তার মেয়ে। কিন্তু তিনি মনোনয়ন পাননি।
সততা, যোগ্যতা, আদর্শ এবং এলাকার জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে দলকে ঢেলে সাজানোর যে পরিকল্পনা নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, গাইবান্ধা তারই একটি বড় উদাহরণ।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, কিছু প্রভাবশালী সংসদ সদস্য মনে করেন এমপির ছেলে এমপি হবে, এটা তাদের অধিকার। এসব মন্ত্রী-এমপির ধারণা ভুল প্রমাণ করে দলের গণতন্ত্র অনুযায়ী সবার এমপির হওয়ার অধিকার আছে, সেই ধারাই প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে আওয়ামী লীগ।
তার উদাহরণ হিসেবে সামনে আনছেন ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনকে। তার মেয়ে ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারজানা রাব্বী বুবলীকে মনোনয়ন না দিয়ে আওয়ামী লীগ এমপিদের পরিবারতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার জোরালো অবস্থান নিচ্ছে।
এর আগে যে কয়টি উপনির্বাচন হয়েছে দুটি ছাড়া বাকি সব আসনে প্রয়াত এমপির পরিবারের বাইরে থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। করোনাকাল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের যেসব এমপি মারা গেছেন, সব কটি উপনির্বাচনে একই ধারা অনুসরণ করেছে ক্ষমতাসীন দলটি।
সর্বশেষ যে দুই ডজন উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এসব শূন্য আসনে দেওয়া বেশির ভাগ মনোনয়নই প্রয়াত এমপিদের পরিবারের বাইরে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিনের এক ধরনের রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসছে দলটি। এতে দলের প্রতি নেতাকর্মীদের আস্থা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে ঢাকা টাইমসের কথা হয়। তারা জানান, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড শূন্য আসনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে এবার প্রচলিত অবস্থানের পরিবর্তন করেছে। তৃর্ণমূল আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিচ্ছেন।
তারা মনে করছেন, দলকে গতিশীল করতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দলের জন্য তা ইতিবাচক। শুধু দলীয় মনোনয়ন নয়, নেতা নির্বাচনেও রয়েছে এখন বাড়তি সতর্কতা। নতুন নেতাকর্মীদের জায়গা করে দেওয়ায় দলের মধ্যে বিদ্রোহী কমবে। মনোনয়ন পেতে দলের শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং উড়ে এসে জুড়ে বসার বিষয়েও দলটি এখন সতর্ক।
ঢাকা মহানগরীতেও এমপিদের পরিবারের বাইরে এসেছে আওয়ামী লীগ। ঢাকা-৫ ও ১৮ শূন্য আসনে প্রয়াত অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ও হাবিবুর রহমান মোল্লার পরিবারের কেউ মনোনয়ন পাননি।
হাবিবুর রহমান মোল্লার আসনে মনোনয়ন পান যাত্রাবাড়ি থানা সভাপতি মনোরুল ইসলাম মনু এবং সাহারা খাতুনের আসনে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিব হাসান মনোনয়ন পান।
সিলেট ৩ আসনের এমপি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ফারজানা চৌধুরী মনোনয়ন চান দলের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমপি পরিবারের মনোনয়ন মেলেনি। মনোনয়ন পেয়েছেন প্রবাস ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমানের।
ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হকের মৃত্যুর কারণে শূন্য আসনে মনোনয়ন চান তার স্ত্রী মাকসুদা হক। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় দলের থানা পর্যায়ের সভাপতি আগা খান মিন্টুকে।
কুমিল্লা-৭ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। এই আসনের প্রয়াত এমপি অধ্যাপক আলী আশরাফের ছেলে মুনতাকিম আশরাফ টিটুও দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন।
একই অবস্থা কুমিল্লা-৫ আসনের পাঁচবারের এমপি আবদুল মতিন খসরুর আসনে। তার মৃত্যুর পর শূন্য আসনে খসরুর ভাই আবদুল মতিন ফেরদৌস ও স্ত্রী মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন মেলেনি এই পরিবারের কারও।
কেবল দুটি আসনে পরিবারের সদস্যরা মনোনয়ন পেয়েছেন। সিরাজগঞ্জের একটি আসনে মোহাম্মদ নাসিম পুত্র তানভিরুল হক জয় এবং বগুড়ার আরেকটি আসনে দলের প্রয়াত নেতা আবদুল মান্নানের স্ত্রী মনোনয়ন পান।
অন্য আসনগুলোতে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা অথবা দীর্ঘদিন নির্বাচনী এলাকায় কাজ করা নেতাদেরই মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো এ রাজনৈতিক দলে এর আগে রীতি অনুযায়ী সব সময় দলীয় নেতাদের পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে অগ্রাধিকার দিত। নেতাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যারা মনোনয়ন এবং দলীয় পদ পেতেন। এমনকি সংসদে সংরক্ষিত আসনেও তাদের জন্য আলাদা কোটা ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে সেই ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে দলটি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ঢাকা টাইমসকে বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় দলের যোগ্য ও ত্যাগীকেই মনোনয়ন দিয়ে থাকে। সব সময় প্রার্থীর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা যাচাই-বাছাই করে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
এমপির পরিবারের সদস্য হলেই তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে- আওয়ামী লীগ এই নীতিতে বিশ্বাসী নয় বলে জানান আওয়ামী লীগের সাংগঠিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘এমপি-মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা যে মনোনয়ন পাবেন না, তাও কিন্তু নয়। এলাকায় জনপ্রিয়তা থাকলে নিশ্চয়ই পাবেন। আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় ও জনপ্রিয়তা আছে, দল তাকেই মনোনীত করছে।’